দেশের গ্যাস-সংকট নিরসনে অবশেষে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে আগামী ডিসেম্বরে দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।
সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকাজে বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড মেকেঞ্জিকে দিয়ে প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্টাক্ট (পিএসসি) সংশোধন করেছে পেট্রোবাংলা। উড মেকেঞ্জি গত ১৮ আগস্ট পেট্রোবাংলার কাছে সুপারিশসহ সংশোধিত পিএসসি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
সংশোধিত পিএসসিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণপদ্ধতি ও উত্তোলিত গ্যাসের ভাগাভাগি নিয়ে বেশ বড় পরিবর্তন এনেছে উড মেকেঞ্জি। একই সঙ্গে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে পাওয়া গ্যাসের দাম একই রাখার প্রস্তাব করেছে তারা।
আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
গভীর ও অগভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলন, অংশ ভাগাভাগি ও বিক্রয়মূল্য নির্ধারণের জন্য পেট্রোবাংলা ২০১৭ সালে মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্টাক্ট (এমপিএসসি) প্রণয়ন করে। এতে অগভীর সমুদ্রে গ্যাসের দাম প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) ৫ দশমিক ৩০ ডলার এবং গভীর সমুদ্রে ৭ দশমিক ২৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সংশোধিত পিএসসিতে গ্যাসের দাম অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ক্রুড অয়েলের) দামের ভিত্তিতে নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) গ্যাসের দাম ১০ ডলারের কাছাকাছি রাখার প্রস্তাব রেখেছে তারা।
উড মেকেঞ্জির দেওয়া সংশোধিত পিএসসির রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য এরই মধ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা। কারিগরি কমিটি উড মেকেঞ্জির সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে চলতি মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে বলে আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
নাজমুল আহসান বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করলেও প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান পিএসপির অধীনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জড়াতে চাচ্ছে না। আমরা এখন চেষ্টা করছি গ্যাসের দাম ও শেয়ারিংয়ে পরিবর্তন এনে বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে।’
নাজমুল আহসান আরও বলেন ‘দেশের গ্যাস-সংকট নিরসনে আমরা চাচ্ছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের জন্য দরপত্র আহ্বান করতে।’ সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পেট্রোবাংলা সর্বশেষ দরপত্র আহ্বান করে ২০১২ সালে। তখন তিনটি অগভীর ও একটি গভীর সমুদ্র ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হলেও তারা অনুসন্ধানকাজ শেষ না করে চলে যায়।
সর্বশেষ কোরীয় প্রতিষ্ঠান পসকো দাইয়্যু তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করলেও কাজ শেষ না করে মাঝপথে চলে যায়। দাইয়্যুকে দেওয়া গ্যাসের দাম ছিল ৬ দশমিক ৩০ ডলার। পরবর্তী সময়ে তারা দাম বাড়িয়ে ৯ ডলারের কাছাকাছি করার শর্ত দেয়। কিন্তু পেট্রোবাংলা দাম না বাড়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় প্রতিষ্ঠানটি কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়।
বিদ্যমান পরিস্থিতি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করে উড মেকেঞ্জি। মেকেঞ্জি তাদের সুপারিশে গ্যাসের দাম আগে থেকে নির্ধারণ করে না দেওয়ার জন্য বলেছে। সুপারিশে বলা হয়, ‘অনেক দেশে প্রমাণিত গ্যাসের মজুত পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী। বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাসের কী পরিমাণ মজুত আছে, তা নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। এই বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আগ্রহী করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যাসের দাম শুরুতে ১০ ডলার করার সুপারিশ করেছে। তবে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা উচিত ক্রুডের দামের একটি অংশের ভিত্তিতে।’
আগের পিএসসিতে গ্যাসের ভাগাভাগি ছিল বাংলাদেশের জন্য ৬০ শতাংশ আর বিনিয়োগকারীদের জন্য ৪০ শতাংশ। গ্যাসের ভাগাভাগি নিয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড মেকেঞ্জি বাংলাদেশের মালিকানা ৪৫ শতাংশ ও বিনিয়োগকারীদের ৫৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রাপ্ত গ্যাসে বাংলাদেশের অংশ কমার ব্যাখ্যা দিয়ে উড মেকেঞ্জির সুপারিশে বলা হয়, ‘গ্যাস উত্তোলনের জন্য সমুদ্রে বাংলাদেশের কোনো অবকাঠামো নেই। বিনিয়োগকারীদের সব অবকাঠামো নতুন করে তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া সমুদ্রে গ্যাসের মজুত নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নাই। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য গ্যাসের মালিকানা ভাগাভাগিতে পেট্রোবাংলাকে উদার হতে হবে। প্রোডাকশন শেয়ারিং বাংলাদেশের ৪৫ শতাংশ ও বিনিয়োগকারীদের ৫৫ শতাংশ করা যেতে পারে।’
তবে অনুসন্ধান ও উত্তোলন পর্যায়ে যদি বড় কোনো গ্যাসের রিজার্ভ পাওয়া যায়, তাহলে পরে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীদের অংশ কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে উড মেকেঞ্জির সুপারিশে উল্লেখ করা হয়।
উড মেকেঞ্জির এমন সুপারিশের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যাসের দাম বাড়ানো ও বাংলাদেশের শেয়ার কমানোর যে সুপারিশ করেছে, তার উদ্দেশ্য হলো বিদেশি কোম্পানিগুলোকে উত্তোলনকাজে আকৃষ্ট করা। জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতার কারণে বাংলাদেশ বিপদে আছে। এখন আসলে দাম না বাড়িয়েও কোনো উপায় নাই।’
বদরুল ইমাম বলেন, ‘বর্তমান যে জ্বালানি-সংকট তার বিবেচনায় পেট্রোবাংলার উচিত গ্যাসের দাম নির্ধারণে একটু আপওয়ার্ড লোকিং থাকা। আমরা যদি সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার পরপর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতাম, তাহলে এ অবস্থায় পড়তে হতো না।’
প্রসঙ্গত, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পর গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেলের অনুসন্ধান করে দেশের জ্বালানি-সংকট সমাধান করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কমই। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বর্তমানে ২৬টি একক অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। তার মধ্যে ১১টি অবস্থিত অগভীর সমুদ্রে আর বাকি ১৫টি গভীর সমুদ্রে।
পেট্রোবাংলার হিসাবমতে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৮৪২ মিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস উৎপাদন করা হয়, তার মধ্যে এলএনজি থেকে আসে ৫৪১ মিলিয়ন কিউবিক ফিট। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের সবটাই আসে অন-শোরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে। সুত্র আজকের পত্রিকা
পাঠকের মতামত